Thursday 16 November 2017

বৃদ্ধাশ্রমের বর্তমান ও ভবিষ্যত

বৃদ্ধাশ্রমের বর্তমান ভবিষ্যত

(এই লেখায় ‘প্রবীণ’ বলতে দুই লিঙ্গকেই বোঝান হয়েছে)

ভারতবর্ষে সামজিকভাবে বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা নেতিবাচক। যাঁরা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারকে হীন চোখে দেখা হয়। নচিকেতার জনপ্রিয় গানটি এই নেতিবাচক চিন্তা থেকেই। যাঁরা এই গানটিকে বাহবা দেন তাঁরা প্রবীণদের পরিসঙ্খ্যান নিয়ে মাথা ঘামান না। সুতরাং পরিসঙ্খ্যান নিয়ে কিছু আলোচনা করে নেওয়া যাক। শেষ জনগনণা (২০১১)অনুসারে ভারতে প্রবীণদের (৬০ বছরের উপর) শতকরা সঙ্খ্যা ৮.৬% (১০ কোটি ৪০ লক্ষ), যা ২০৫০ সালে হবে ২০% (২৯ কোটি ৬৬ লক্ষ)। দেখা যাচ্ছে যে, সাধারণ জনসঙ্খ্যার তুলনায় প্রবীণদের জনসঙ্খ্যা অনেক দ্রুত তালে বাড়ছে। ১৯৭০ সালে যেখানে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৮ বছর, সেখানে ২০১১ সালের পরিসঙ্খ্যান অনুসারে তা দাঁড়িয়েছে ৬৭ বছর। এর প্রধান কারণগুলি হলঃ শিক্ষার ক্রমবর্ধমান হার, গড় আয়ের বৃদ্ধি, চিকিৎসা বিজ্ঞাণের উন্নতি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কর্মী মানুষের সঙ্খ্যা কমছে আর নির্ভরশীল মানুষের সঙ্খ্যা বাড়ছে। এখন প্রত্যেকটি পরিবারই অণু পরিবার এবং মোটামুটি ৩১% পরিবারে ১-২ জন প্রবীণ বসবাস করেন। ১২% প্রবীণ একাকী বাস করেন এবং ১৯% প্রবীণ স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে বাস করেন। ৬৫% প্রবীণকে কোন না কোন ভাবে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়।

সামাজিকভাবে এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে একজন প্রবীণের সাহায্য বা সেবাসুশ্রুষা করার জন্য পরিবারের সদস্যদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, ফলে বাইরে থেকে লোক খুঁজতে হয়, যা অর্থনৈতিকভাবে পরিবারে পক্ষে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে সাধারনতঃ সরকারই প্রবীণ মানুষদের দেখভাল করে হোমে রেখে। প্রবীণ মানুষদের দুভাবে দেখভাল করা যায়ঃ ১) কোন হোমে (old age home) রেখে, ২) বাড়িতে গিয়ে পরিষেবা (house service)দিয়ে। দ্বিতীয় পরিষেবাটি দু একটি মেট্রো শহরে সবে শুরু হয়েছে। ভারতে দু রকম হোম দেখা যায়। একটি সরকার পরিপোষিত ফ্রি হোম, যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অল্প। আর আছে টাকার বিনিময়ে থাকার ব্যবস্থা। সর্বভারতীয়ভাবে এখনও পর্যন্ত হোম বানানোর কোন রূপরেখা তৈরী হয় নি, যার জন্য কোন মাপকাঠির তোয়াক্কা না করেই আনাচে কানাচে হোম গজিয়ে উঠছে।

যাই হোক না কেন, আজ আমাদের দেশেও হোমের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হয়ে উঠছে। এমন একদিন আসবে যেদিন প্রত্যেক প্রবীণ মানুষকেই হয় হোমে যেতে হবে, না হয় হাউস সার্ভিস পরিষেবা কিনতে হবে। হোমে থাকা অর্থাৎ কমিউনিটি লিভিং-এ থাকার অনেকগুলো সুফল আছে। একসাথে অনেক সমবয়স্ক মানুষ বাস করলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভাল থাকে, বাড়িতে রাখার থেকে খরচ অনেক কম হয়, বাড়ির উপার্জনকারী মানুষেরা নিশিন্ত থাকতে পারেন। তবে এই শর্তে যে, হোমটির যেন একটি নির্দিষ্ট মান থাকে এবং বিজ্ঞান সম্মতভাবে পরিচালিত হয়।  

এছাড়াও প্রবীণ মানুষদের বাসস্থান নিয়ে আরো প্রয়োজন তৈরী হয়। সেটা হল সাময়িক বসবাসের (respite care home) জন্য। ধরূন, পরিবাররের সদস্যদের কোন কারণে একসাথে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, অথচ বাড়িতে অসুস্থ প্রবীণ থাকার জন্য যেতে পারছেন না; এমতাবস্থায়, স্বল্পকালীন সময়ের জন্য কোন হোমে রাখা যেতে পারে। এরকম ব্যবস্থা পশ্চিমবাংলায় নেই বললেই চলে। এছাড়াও অনেক একাকী প্রবীণকে চিকিৎসার জন্য বা সেবাসুশ্রুষার জন্য অন্যের সাহায্য নিতে হয়। এরকম অবস্থায় পেশাদারদের সাহায্য নেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু ভারতে কিছুদিনের জন্য হোমে রেখে চিকিৎসা করার ব্যবস্থা অপ্রতুল। প্রবীণ মানসিক প্রতিবন্ধী, শারিরীক প্রতিবন্ধী, ডিমেন্সিয়া, বিছানায় শয্যাশায়ী প্রবীণদেরও (hospice) রাখার জায়গা সত্যি সত্যি নেই বললেই চলে। যাদের বাড়িতে এই ধরণের রোগী আছে তাঁরা বোঝেন যে এর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এখনকার সামাজিক কাঠামোতে প্রবীণদের আবাসনের কত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এবং এটি সমাজের বাইরে নয়। আজকে যিনি মুখ বেঁকাচ্ছেন, কাল তাঁরই না প্রয়োজন হয়ে পড়ে।


No comments:

Post a Comment