Tuesday 28 November 2017

প্রবীণদের চিকিৎসা সহ সেবা যত্ন সম্পর্কে সাধারণ কিছু কথা

এবারে আসুন প্রবীণদের সেবা নিয়ে কিছু আলোচনা সেরে নাওয়া যাক। বড়সড় কোন অসুখ যেমন, হার্ট, কিডনী ইত্যাদির অসুখ না থাকলে প্রবীণরা সাধারনতঃ ডায়াবেটিস, বাত, হাই প্রেশারে ভোগেন। বেশীরভাগ প্রবীণেরা বিশ্রাম প্রবণ - সারাদিন বিছানাকেই সঙ্গী করেন - ব্যয়াম বা কর্মে বিমুখ হন। তার জন্য তাঁরা বিভিন্ন ব্যথা, নিদ্রাহীণতায় ভোগেন। তার সাথে যোগ হয় অবসাদ। এছাড়া অনেকেই কমবেশী স্মৃতিভ্রংশ, অসংলগ্ন কথাবার্তা ও আচরণ এবং প্রস্রাবের সংযমহীণতায় ভোগেন। এই সব সমস্যাগুলি যখন ফ্ল্যাট বা বাড়ির ছোট্ট চৌহদ্দীর মধ্যে ঘটে তখন বাড়ির অন্যান্য মানুষেরা বিরক্ত হন এবং তা দেখে প্রবীণ মানুষটি আরো বেশী অবসাদে ভুগতে থাকেন। বিশেষ কোন অসুখ না থাকাতেও তিনি আস্তে আস্তে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন এবং মৃত্যুকে কাছে ডেকে আনেন।
একজন প্রবীণ মানুষ যতই অসংলগ্ন কথাবার্তা বলুনই না কেন, তিনি কথা বলতে বা মানুষের সান্নিধ্য পছন্দ করেন। পরিবারের প্রত্যেককেই কোন না কোন কাজে ব্যস্ত থাকার দরুন, তার জন্য সেই সময়টুকু ব্যয় করতে অপারগ হন। আয়া রাখা হলে তারা যন্ত্রের মত কাজ করেন, কিন্তু ওই প্রবীণ মানুষটির মনের কাজটা করেন না, বা জানেন না, অর্থাৎ তাঁর সাথে গল্প করা বা সাহচর্য দেওয়া ইত্যাদি করেন না - বরং বিরক্ত হন
প্রবীণ মানুষদের বিছানায় প্রস্রাব করা ভীষণরকম স্বাভাবিক। কেউ কেউ পায়খানাও করে ফেলেন। কিন্তু যিনি তাঁর সেবা যত্ন করেন, বারে বারে তার জামা-কাপড় বদলাতে হলে বিরক্ত হন।
প্রবীণ মানুষদের কলকব্জাগুলি কমজোরী হয়ে যাওয়াতে ইমিউনিটি পাওয়ার কমে যায়, ফলে ঘন ঘন সঙ্ক্রমণে ভোগেন। সঙ্ক্রমণের প্রধান জায়গাগুলি হল বুক বা লাংস, মূত্রথলী ও পেট। প্রবীণদের সঙ্ক্রমন হয় বড় নিঃশব্দে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এগুলো এড়ানো যায়।
যত না বাতের ব্যথা, তার থেকে বেশী ব্যথা হয়, হাঁটা চলায়, কাজে বিমুখতা থেকে - শুধু বিছানায় শুয়ে থেকেপ্রবীণ মানুষদের হাঁটতে বললে বা ব্যয়াম করতে বললে অসম্ভব রেগে যান – শুধুই বিছানায় শুয়ে পড়তে চান – তার ওপর যদি একটু ভারী ওজনের হন, তাহলে তো কথাই নেই। ব্যথা বেদনার জন্য ডাক্তার দেখালে তিনি ফিজিওথেরাপিস্টের শরণাপন্ন হতে বলেন। তার মানে একেকটা সিটিংএ ২০০-২৫০ টাকা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বাড়ির কেউ বা আয়া একটু দেখে নিলেই এই খরচটা বাঁচাতে পারেন। একটু আধটু হাঁটানো, একটু ব্যয়াম, একটু ম্যাসাজ করাতে পারলেই হয়। আয়ারা এসব ক্ষেত্রে এড়িয়ে যান। তবে বিশেষ বিশষ ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপিস্টের প্রয়োজন অবশ্যই হয়। তাহলে এবার হিসাব করুনঃ দু বেলা আয়া, মানে কমপক্ষে ২০০ x ২ = ৪০০ এবং ফিজিওথেরাপিস্টের জন্য আরো ২০০, মোট ৬০০ টাকা ঘরে থেকেও খরচ। তার ওপর চিন্তা থাকে আজ আয়া আসবে তো।
এর পর আরেকটা ভয়জনক জিনিষ হল, পড়ে যাওয়া। যেহেতু প্রবীণদের ভারসাম্য অনেক কমে যায়, তাই তাঁদের পড়ে যাওয়ার প্রবণতাও বেশী। প্রবীণদের হাড়ের ঘনত্ব ক্রমশঃ পাতলা হতে থাকার দরুণ ভঙ্গুর হয়ে ওঠে। সাহায্যকারীকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে তিনি পড়ে না যান। পড়ে গেলে সাধারনতঃ পায়ের বড় হাড়টা (ফিমার) ভাঙ্গে, ফলে সারানোর জন্য তাঁকে ছয় মাস বিছানায় শুয়ে পড়ে থাকতে হয়। সুতরাং সব সময় সতর্ক থাকতে হয়।
অনেক প্রবীণ ধীরে ধীরে খিটখিটে হয়ে ওঠেন, গালাগালি দেন, মারধর করেন, থুতু ছেটান, খাওয়া নিয়ে বায়না করেন। এরাঁ ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলেই সাহায্যকারীকে মারধর করেন। যে বাড়িতে এরকম ঘটে সে বাড়িতে আয়া কাজ করতে চায় না। এই সব প্রবীণেরা শিশুদের মত আচরণ করেন – নিজেদের বোধে করেন না। সাহায্যকারীদের এই বোধটুকু থাকলেই এই ধরণের প্রবীণদের হ্যান্ডেল করা সহজ হয়ে ওঠে।
সবার উপরে আসল কথা হল, একটু ভালোবাসা, একটু আন্তরিক ব্যবহার, একটু সাহচর্য। এর সাথে দরকার হয় একটু আনন্দ দান করার ব্যবস্থা। শুধু মাত্র টিভি দেখা নয় (অনেক প্রবীণ টিভি দেখতে ভালোবাসেন না), একটু আধটু গান বাজনা (লাইভ) শোনানো, বাইরে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসা, খবরের কাগজ পড়া অভ্যাস করানো ইত্যাদি। তাহলেই ওই মানুষটা আরো কিছুদিন বেশী বাঁচেন। বাঁচেন তৃপ্তির সাথে।
একজন প্রবীণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যখন এই ধারা পালন করা হয়, তখন তিনি ধীরে ধীরে জীবনীশক্তি ফিরে পেতে থাকেন। ওষুধের উপর নির্ভরতা কমতে থাকে, অর্থাৎ ওষুধ খরচ কমতে থাকে। সঠিক খাবার, নিয়মিত প্রেশার, সুগার ইত্যাদি মনিটর করলে হঠাৎ বিপদ এড়ানো যায়। আর তার প্রতিফলন ঘটে মাসিক ওষুধের বিলে –মাসের নিয়মিত খরচ কমে যায়।
ওপরের কথাগুলি কোন বই থেকে নেওয়া নয়, দীর্ঘ আট বছরের অভিজ্ঞতা থেকে একটু একটু করে শেখা। কমিউনিটি লিভিং-এ এই ব্যবস্থাগুলো একসাথে করলে মাথাপিছু খরচ কমে যায়। তার সাথে আরো একটা বিশেষ উপকার হয়। সেটা হল, একসাথে অনেক সমবয়স্ক মানুষ বাস করার জন্য তাদের মধ্যে আর একাকীত্ব গড়ে ওঠে না – অবসাদ অনেকটা দূর হয়।
প্রবীণ মানুষদের জীবনধারণকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়ঃ ১) ফ্রি লিভিং, মানে যার দৈনন্দিন কাজ কর্ম (স্নান, পায়খানা, জামা কাপড় পড়া, খাওয়া ইত্যাদি) করতে কারো কোন সাহায্য লাগে না; ২) অ্যাসিস্টেড লিভিং, মানে যার দৈনন্দিন কাজে অন্যের সাহায্য লাগে। এটা আবার দু ভাগে ভাগ করা যায়ঃ ২ক)পার্শিয়াল, মানে একটু সাহায্য করলেই তিনি বাথরুমে যেতে পারেন, নিজে হাতে খেতে পারেন, কোন কিছুর সাহায্য নিয়ে হাঁটতে পারেন; ২খ)কম্পলিট, মানে যিনি চলৎশক্তিবিহীন, মলমূত্র বিছানাতেই ত্যাগ করেন, অন্যকে খাইয়ে দিতে হয়।
আমরা অ্যাসিস্টেড লিভিং (পার্শিয়াল ও কম্পলিট) করেন এমন মানুষদের নিয়েই কাজ করিবেশীরভাগ হোমগুলি শুধুমাত্র সুস্থ প্রবীণ রাখতে চায়, চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে চায়্ না। কমিউনিটি লিভিং-এর মাধ্যমে রেখে বাড়ীতে রাখার থেকে অনেক কম খরচে ভালো রাখতে পারিতার প্রমান পেতে যেসব আবাসিকরা এখানে আছেন তাদের পরিবারের সাথে কথা বলুন নিজে এসে চোখে দেখলেও খানিকটা অনুভব করতে পারবেন বৈকি। আসার সময় সাথে নিয়ে আসবেন প্রবীণ মানুষদের জন্য একটা সহানুভূতিশীল মন। আমরাও তো প্রবীণ হব, তাই নয় কি।  

   


Thursday 16 November 2017

বৃদ্ধাশ্রমের বর্তমান ও ভবিষ্যত

বৃদ্ধাশ্রমের বর্তমান ভবিষ্যত

(এই লেখায় ‘প্রবীণ’ বলতে দুই লিঙ্গকেই বোঝান হয়েছে)

ভারতবর্ষে সামজিকভাবে বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা নেতিবাচক। যাঁরা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারকে হীন চোখে দেখা হয়। নচিকেতার জনপ্রিয় গানটি এই নেতিবাচক চিন্তা থেকেই। যাঁরা এই গানটিকে বাহবা দেন তাঁরা প্রবীণদের পরিসঙ্খ্যান নিয়ে মাথা ঘামান না। সুতরাং পরিসঙ্খ্যান নিয়ে কিছু আলোচনা করে নেওয়া যাক। শেষ জনগনণা (২০১১)অনুসারে ভারতে প্রবীণদের (৬০ বছরের উপর) শতকরা সঙ্খ্যা ৮.৬% (১০ কোটি ৪০ লক্ষ), যা ২০৫০ সালে হবে ২০% (২৯ কোটি ৬৬ লক্ষ)। দেখা যাচ্ছে যে, সাধারণ জনসঙ্খ্যার তুলনায় প্রবীণদের জনসঙ্খ্যা অনেক দ্রুত তালে বাড়ছে। ১৯৭০ সালে যেখানে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৮ বছর, সেখানে ২০১১ সালের পরিসঙ্খ্যান অনুসারে তা দাঁড়িয়েছে ৬৭ বছর। এর প্রধান কারণগুলি হলঃ শিক্ষার ক্রমবর্ধমান হার, গড় আয়ের বৃদ্ধি, চিকিৎসা বিজ্ঞাণের উন্নতি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কর্মী মানুষের সঙ্খ্যা কমছে আর নির্ভরশীল মানুষের সঙ্খ্যা বাড়ছে। এখন প্রত্যেকটি পরিবারই অণু পরিবার এবং মোটামুটি ৩১% পরিবারে ১-২ জন প্রবীণ বসবাস করেন। ১২% প্রবীণ একাকী বাস করেন এবং ১৯% প্রবীণ স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে বাস করেন। ৬৫% প্রবীণকে কোন না কোন ভাবে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়।

সামাজিকভাবে এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে একজন প্রবীণের সাহায্য বা সেবাসুশ্রুষা করার জন্য পরিবারের সদস্যদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, ফলে বাইরে থেকে লোক খুঁজতে হয়, যা অর্থনৈতিকভাবে পরিবারে পক্ষে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে সাধারনতঃ সরকারই প্রবীণ মানুষদের দেখভাল করে হোমে রেখে। প্রবীণ মানুষদের দুভাবে দেখভাল করা যায়ঃ ১) কোন হোমে (old age home) রেখে, ২) বাড়িতে গিয়ে পরিষেবা (house service)দিয়ে। দ্বিতীয় পরিষেবাটি দু একটি মেট্রো শহরে সবে শুরু হয়েছে। ভারতে দু রকম হোম দেখা যায়। একটি সরকার পরিপোষিত ফ্রি হোম, যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অল্প। আর আছে টাকার বিনিময়ে থাকার ব্যবস্থা। সর্বভারতীয়ভাবে এখনও পর্যন্ত হোম বানানোর কোন রূপরেখা তৈরী হয় নি, যার জন্য কোন মাপকাঠির তোয়াক্কা না করেই আনাচে কানাচে হোম গজিয়ে উঠছে।

যাই হোক না কেন, আজ আমাদের দেশেও হোমের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হয়ে উঠছে। এমন একদিন আসবে যেদিন প্রত্যেক প্রবীণ মানুষকেই হয় হোমে যেতে হবে, না হয় হাউস সার্ভিস পরিষেবা কিনতে হবে। হোমে থাকা অর্থাৎ কমিউনিটি লিভিং-এ থাকার অনেকগুলো সুফল আছে। একসাথে অনেক সমবয়স্ক মানুষ বাস করলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভাল থাকে, বাড়িতে রাখার থেকে খরচ অনেক কম হয়, বাড়ির উপার্জনকারী মানুষেরা নিশিন্ত থাকতে পারেন। তবে এই শর্তে যে, হোমটির যেন একটি নির্দিষ্ট মান থাকে এবং বিজ্ঞান সম্মতভাবে পরিচালিত হয়।  

এছাড়াও প্রবীণ মানুষদের বাসস্থান নিয়ে আরো প্রয়োজন তৈরী হয়। সেটা হল সাময়িক বসবাসের (respite care home) জন্য। ধরূন, পরিবাররের সদস্যদের কোন কারণে একসাথে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, অথচ বাড়িতে অসুস্থ প্রবীণ থাকার জন্য যেতে পারছেন না; এমতাবস্থায়, স্বল্পকালীন সময়ের জন্য কোন হোমে রাখা যেতে পারে। এরকম ব্যবস্থা পশ্চিমবাংলায় নেই বললেই চলে। এছাড়াও অনেক একাকী প্রবীণকে চিকিৎসার জন্য বা সেবাসুশ্রুষার জন্য অন্যের সাহায্য নিতে হয়। এরকম অবস্থায় পেশাদারদের সাহায্য নেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু ভারতে কিছুদিনের জন্য হোমে রেখে চিকিৎসা করার ব্যবস্থা অপ্রতুল। প্রবীণ মানসিক প্রতিবন্ধী, শারিরীক প্রতিবন্ধী, ডিমেন্সিয়া, বিছানায় শয্যাশায়ী প্রবীণদেরও (hospice) রাখার জায়গা সত্যি সত্যি নেই বললেই চলে। যাদের বাড়িতে এই ধরণের রোগী আছে তাঁরা বোঝেন যে এর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এখনকার সামাজিক কাঠামোতে প্রবীণদের আবাসনের কত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এবং এটি সমাজের বাইরে নয়। আজকে যিনি মুখ বেঁকাচ্ছেন, কাল তাঁরই না প্রয়োজন হয়ে পড়ে।